শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

‘ঝড় আসবে শুনতেছি, আমাদের কী হবে আল্লাহ জানে’

অনলাইন ডেস্ক | আপডেট: শুক্রবার, মে ১২, ২০২৩

‘ঝড় আসবে শুনতেছি, আমাদের কী হবে আল্লাহ জানে’
উন্নয়নের কথা শুধু শুনেই গেলাম, কখনো চোখে দেখলাম না। না পেলাম রাস্তাঘাট, না পেলাম বেড়িবাঁধ। কতজন কত প্রতিশ্রুতি দিলো, অথচ বৃষ্টি হলেই কাদামাটি মেখে চলাচল করতে হয়। জুতা তো দূরে থাক খালি পায়েও ঠিকমত হাটা যায় না। এভাবেই আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়নের শতবর্ষী বৃদ্ধ আব্দুল কমালেক।

সদর উপজেলার নিকটবর্তী কাড়াপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ মাঝিডাঙ্গা এলাকা। এই এলাকাতেই ভৈরব নদের কোল ঘেষে ১৯৯৭ সালে গড়ে ওঠে খানজাহান আলী আশ্রয়ণ প্রকল্প। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৬টি ব্যারাকে বসবাস করেন ৬০টি পরিবারের তিন শতাধিক মানুষ। এছাড়া গ্রামে বাস করেন আরও হাজারের বেশি মানুষ। প্রতিবছর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে জোয়ারের পানিতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের। জোয়ারের পানি ঢুকে ভাসিয়ে নেয় ঘর-বাড়ি। ঘরের মধ্যে পানি ঢুকে যাওয়ায় রান্নাও বন্ধ হয়ে যায় বাসিন্দাদের। দীর্ঘদিন ধরে বেড়িবাঁধের দাবি জানালেও জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের মৌখিক আশ্বাসেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের।

শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী পাড়ের বগী এলাকায় কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর রয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘরে থাকেন আশির্ধ্বো জয়নব বিবি। সিডরে হারিয়েছেন থাকার জায়গাটুকু। সন্তানেরা বাইরে থাকায় কোনো রকম মানুষের কাছে চেয়ে দিন কাটে তার। বাঁধের পাশে ঘরটুকু রয়েছে তাও যে কোনো সময় পড়ে যেতে পারে। হালকা বাতাস হলেও দুঃশ্চিন্তায় রাত জেগে বসে থাকতে হয় তাকে। এই নড়বড়ে ঘরই তার একমাত্র সম্বল।

অরক্ষিত বেড়িবাঁধে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বছরের পর বছর ধরে বাস করছেন উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, জেলায় টেকসই বাঁধ রয়েছে ৩৩৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার এলাকা। আর অরক্ষিত রয়েছে রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও সদর উপজেলার অন্তত ১৩০ কিলোমিটার এলাকা।

আবার নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধেও ফাটলের ঘটনা ঘটছে। ফলে বাঁধ এলাকাতেও আতঙ্কে থাকছেন সাধারণ মানুষ। গত বছর মে মাসে শরণখোলা উপজেলায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মানাধীন বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দেয়। মূহুর্তেই ফেটে যাওয়া এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা গাবতলা গ্রামের ছফেদ খানের ১০ কাঠা জমি গাছপালাসহ নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যায়। জমি হারানো ছফেদ খান বলেন, বাপ-দাদার অনেক জমি হারিয়েছি আমরা।
বেড়িবাঁধের বাইরে আমার ৬৫ শতক জমি ছিল গত বছর। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যায় অনেকখানি।

নির্মানাধীন বাঁধের মধ্যে মাটি না দিয়ে বালু দেওয়ায় এমন ফাটল ধরছে বলে দাবি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর। সাউথখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য জাকির হোসেন বলেন, শরণখোলা উপজেলাকে রক্ষার জন্য একটি টেকসই বেড়িবাঁধ আমাদের প্রাণের দাবি ছিল। সরকার বরাদ্দও দিয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছেমত কাজ করেছে ঠিকাদাররা। যেখানে মাটি দেওয়ার কথা সেখানে বালু দিয়েছে। যার ফলে নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার আগেই ফাটল দেখা দিচ্ছে।

দেড় যুগ ধরে মাঝিডাঙ্গা আশ্রয়নে বাস করা স্থানীয় কুতব আলি বলেন, নদীর পাশে থাকলেও আমাদের এখানে কোনো বাঁধ নেই। প্রতিবছরই জোয়ারের পানিতে আমাদের ডুবতে হয়। বিশেষ করে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে হাটু সমান পানি উঠে যায় সব জায়গায়। স্থানীয়রা মিলে যে বাঁধ দেই, তা পানির চাপ বাড়লেই ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গলে বড় স্যাররা, নেতারা দেখতে আসে। সমাধানের আশ্বাস দিয়ে যায়। কিন্তু আমরা শুধু আশ্বাস-ই পাই। এই যে ঝড় আসবে শুনতেছি, আমাদের কী হবে এক আল্লাহ জানে।

এ বিষয়ে বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকা আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে ত্রিশ হাজার জিওব্যাগ ও দশ হাজার সিনথেটিক ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আজিজুর রহমানের বলেন, জেলার সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলায় ৪৪৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যেখানে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭৫ জন আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবেন।

তিনি আরও বলেন, জেলা সদর ও প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ৯ উপজেলায় ৮৪টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিস ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কয়েক’শ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ত্রাণ প্রদানের জন্য ৫২২ দশমিক ৮০০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১০ লক্ষ ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
0 Comments